একবিংশ শতাব্দীর দর্শন পুরাণ

স্বপ্ন, সত্য, স্বত্ব ও সত্ত

১.

প্রেম, শুধুই এক তরুণ-তরুণীর ভালোবাসার নাম? শুধু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পূর্বের ভালোবাসা-বাসির রেকর্ড ? প্রেম, শুধুমাত্রই বনে-বাঁদাড়ে হাত ধরে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ? প্রেম হচ্ছে সমগ্র জগতের মধ্যে একটি দীর্ঘশাস- এটা এমন একটি জীবন, যে জীবনে প্রেম থেকে সমস্ত কিছুর সৃষ্টি। কোন কাজ, কাজের প্রতি ভালোবাসা এবং ভালোবাসার মধ্যে কাজ করার সাথে সাথে যে প্রেম তৈরি হয়, সে প্রেম না থাকলে কাজের প্রতি অনীহা তৈরি হয়। প্রেমটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যত গল্প-উপন্যাস-কবিতায় তা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, সে ব্যাখ্যার অনেক সংক্ষিপ্ত বা বর্ণনাতীত বর্ণনা আছে। কিন্তু সামান্য কিছু বর্ণনা আড়ালে রয়ে যায়, সে আড়ালে পড়ে থাকা প্রেম চোখে পড়ে না। কাজের প্রতি, সম্মানের প্রতি, সমস্ত সৃষ্টির প্রতি একটু চাহনি, যেই চাহনিতে থাকবে সমস্ত শ্রদ্ধা, অন্তরের অন্তস্থল থেকে ভালোবাসা, থাকবে কিছু সংশয়হীন অনুভূতি, কিছু বিশ্বাস যেখান থেকে প্রেমের সৃষ্টি হবে। জগত প্রেমের মধ্যে একটা আবিষ্কার আছে, যে আবিষ্কারের মধ্যে আমরা সব সময় বিজ্ঞানী হয়ে ঘুরে বেড়াই। প্রেমিক বা প্রেমিকা না হলে সে আবিষ্কার সম্ভব নয়। কোন যন্ত্রের প্রতিও থাকতে পারে প্রেম, কোন পত্রের প্রতিও থাকতে পারে প্রেম, কোন আসবাবপত্রের প্রতিও থাকতে পারে প্রেম আবার কোন কিছুর প্রতি অনীহাও থাকতে পারে, তাও প্রেম। প্রেমকে ব্যাখ্যা করা কঠিন;তথাপি সহজ, তারপরও প্রেম। যেখানে প্রেম নেই, ভালোবাসা নেই, আকর্ষণ নেই, কিছুই নেই, সেটা কেবল বেঁচে থাকা। কামড় দিয়ে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা, সে বেঁচে থাকার মধ্যে কিছু গল্প জড়িত হয়ে যায়, কাহিনী জড়িত হয়ে যায়, ধীরে ধীরে আমরা বুঝতে পারবো প্রেমের শেষ নেই আবার অনেক সময় এর শুরুও নেই। কারণ যেখানে প্রেমের শুরু আছে, সেখানে প্রেমের শেষ নেই। আর যেখানে প্রেম শেষ হয়ে যায়, এর মানে এর শুরুই হয় নাই।

২.

স্বপ্ন তাই যার মধ্যে কিছু আবেগ, কিছু অতৃপ্ত ভালোবাসা, কিছু অসম্পূর্ণতা যার সম্পূর্ণতা কখনোই হয় না। সেই জিনিসগুলা প্রকাশ করায় স্বপ্ন, যেখানে অনেক বিভক্ত, বিচ্ছিন্ন, চারিদিকে হাহাকার, তার একটি পূর্ণতা, তার একটি সম্পূর্ণতা প্রকাশ করে নিস্তার পাওয়ার জন্য।
স্বপ্ন, এমন কিছু অসম্পূর্ণ ঘটনার সম্পূর্ণতা দেয়, এমন কিছু ঘটনার পরিপূর্ণতা দেয় যা পরিপক্কতার ভর করে। যেখানে জীবন এক সময় থেমে গিয়েছিল, থেমে থাকা জীবনের চলন্ত-বাড়ন্ত বিষয়টাকে বাড়তি আক্ষেপ দেওয়ার জন্য যে প্রকাশটা।
স্বপ্ন, যেখানে নিস্তেজ হয়ে যায় কিছু অনুভুতি, যেখানে নিজের সম্পূর্ণ আবেগ, পড়ে থাকা কিছু ব্যথা-বেদনা, কিছু অপেক্ষার চলমান গতিশীলতা নষ্ট হয়ে যায়। চলতে থাকে অন্য সব চিন্তা-ভাবনাগুলো যেগুলার প্রকাশ খুব প্রয়োজন কিন্তু জায়গা পায়না প্রকাশ করতে। এর মানে সেগুলো বন্দি রয়ে যায়।
স্বপ্ন, যেখানে নিথর প্রথর অনুভূতি গুলো দাঁড়িয়ে থাকে একটি গাছের মতো। মাঝে মাঝে আঁকড়ে ধরে রাখে, ছেড়ে দেয় না, ফেলে দেয় না, ঝরে পড়ে না। কোষ্ঠকাঠিন্য মন-মানসিকতার মতো মাঝে মাঝে কাঠঠোকরা এসে যখন অনেক বেশি জোরাজুরি করে গাছের সাথে, গাছের এক কোণা ঠুকরের মধ্যে, তখন গিয়ে গাছ একটু নাড়া দেয় কিন্তু তারপরও থেমে থাকে, তার থেমে থাকা শুধূ দেখতে পাই কিন্তু তার মাটির নিচে চলমান, তাই দেখতে হয় স্বপ্নে।


স্বপ্ন, আবেগ ও বাস্তবের মাঝখানের একটা সময়, যে সময়টা শেষ হবার নয়। শুরু, এমন কিছু জিনিসের শুরু; যে জিনিসের শুরুটা হয়তোবা থেমে থাকার মতো, হয়তোবা চলে যাওয়ার মতো, হয়তোবা দুইয়ের মাঝখানে সম্পর্কটা না বোঝার মতো।
স্বপ্ন, যার ফিল্টারিং করা এবং আনফিল্টারড হয়ে আসা কিছু অনুভূতি যেগুলার মানসিক ধাপগুলো নষ্ট হওয়ার মতো কিন্তু চাইলেও তা নষ্ট হয় না, পঁচে যায় না, গন্ধ হয় না। একটা স্বপ্ন, সেই স্বপ্নেরই আবেগগুলো তাজা পড়ে থাকে, সে তাজা পড়ে থাকা স্বপ্নগুলো কিভাবে তাজা থাকে? থাকে না, সেগুলা ঘুমিয়ে থাকে, তাদেরকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয় কিন্তু যখনই তারা জেগে ওঠে তারা তাজা হয়ে যায়। কিন্তু তারা মরে যায় না, নিথর হয়ে যায় না, স্থির হয়ে যায় না, গন্ধ হয়ে যায় না। শুধুমাত্র তারা তাজাই থাকে, তাজা পড়ে থাকে, ঘুমিয়ে থাকে, জেগে উঠলেই অন্য আঙ্গিক্ষেত্রিক জীবনটা চলে যায়, অন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে জীবনটা নিমিষে চলে যায় এই জন্য, তাই স্বপ্ন। এই স্বপ্নের মধ্যে থাকে চরম বাস্তবতা এবং অলীকের কিছু মিশ্রণ। ব্যস্ত জগতে যখন উঠে দেখি, কিছু প্যারালাল অনুভূতিগুলা অনুভূত হয়। স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে বিস্তর একটা সময়েন সম্পর্ক। এই সময়ের সম্পর্কগুলো মাঝে মাঝে নাড়া দেয় কিন্তু সময় তো প্রতি মিনিটে-সেকেন্ডে-ঘন্টায় মরে যাচ্ছে। যে সময়টা যাচ্ছে সে সময়টা ফিরে আসছে না। আর যেটা ফিরে আসে না সেটা মৃত। কিন্তু মৃত থেকেও কেন যেন মৃত নয়, স্বপ্ন ঠিক তাই যা সময়ের নাম- যে সময়টার মধ্যে প্রত্যেকটা মানুষ পঁচে এবং সেটা সম্পূর্ণভাবে অনুভব করে শরীরে সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে, সমস্ত স্পর্শ দিয়ে সে অনুভব করে কিন্তু বাস্তবে যখন সে ফিরে আসে তখন সে অনুভূতিটা তার মধ্যে থেকে যায়; মরে যায় না, সে অনুভূতি থেকে জন্ম হয় অন্য এক অনুভূতির, সে আবেগ থেকে জন্ম হয় অন্য এক আবেগের, সে বাস্তব রুপ ধারণ করে অন্য এক বাস্তবের ।

৩.

একবিংশ শতাব্দীর মানব দর্শন
প্রকৃতি যেমন তোমাকে অনেক বেশি আগলে রাখবে, প্রকৃতির মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু জীবন তোমাকে অনেক বেশি অত্যাচারও করবে। দিনে-রাতে, গভীর রাতে, স্বপ্নে, বাস্তবে, অলীকে, কল্পনাতে সব জায়গায় তোমাকে অত্যাচার করবে। বিভিন্নভাবে তোমাকে বিরক্ত করবে। এটা স্বাভাবিকতার অন্তরালে একটা রহস্য। এ রহস্য কেউ কখনো উদঘাটন করতে চায় না। কারণ উদঘাটন করতে গেলে এর পেছনে লেগে থাকতে হয়। সারাদিনের মধ্যে আমাদের সময়ই বা কতটুকু থাকে যে, আমরা সময়ের অন্তরালে কোন রহস্য থাকলে তা উদঘাটন করবো? করি না, ফেলে রাখি। এজন্যই আমাদের খারাপ লাগা-ভালো লাগাগুলো কখনো মরে যায় না। খারাপ লাগাগুলো কখনো থেমে থাকে না? লাগতেই থাকে? ভালো লাগাগুলো কখনো পরিবর্তন হয়না, আর ভালো লাগার পরিমাণও দেখা গেছে খারাপ লাগার বাড়ন্ত ইচ্ছাগুলোর কারণে ভালো লাগাগুলো কমতে থাকে। একটা সময়ের পরে ভালো লাগাগুলো আর ভালো লাগা মনে হয় না, স্বাভাবিক মনে হয়। মানুষের শরীররটা একটা যন্ত্রের মতো; এমন একটা যন্ত্র, যেটাকে মানবযন্ত্র বলে। এই যন্ত্র প্রকৃতিরই সৃষ্টি। প্রাকৃতিক জিনিস দিয়ে এ যন্ত্রটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। আর মানব যেই যন্ত্রটা তৈরি করেছে সেই যন্ত্রগুলো, বিভিন্ন আকার দিয়ে অনেক ধরনের বাস্তবের চলমান শক্তিগুলোকে কাজে লাগিয়ে সামনে দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সাহায্য করে সেগুলো। আসলে কখনো কোন কিছুর মাঝে কিছু থাকে, যেই কিছুটা আমাদের ভেতরের অতীত অভিজ্ঞতা দিয়ে আমরা যাচাই করি। কিছু দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন থাকে, কিছু থাকে না। কারো খারাপ লাগাগুলো খারাপ লাগা নিজের কাছে মনে হয় না। কারো কষ্ট পাওয়া গুলো মনে হয় যে ভন্ডামী, ভনিতা, অভিনয়। কারো কষ্টগুলোও কষ্ট মনে হয় না, অভিনয় মনে হয়। মানুষ নামের যন্ত্রকে প্রকৃতি যন্ত্রের সাথে সাথে মানবসৃষ্ট কিছু যন্ত্রের মতোও হয়ে যেতে হয়। কিছু অনুভূতিকে পুরোপুরি ভাবে আগুন ধরিয়ে দিতে হয়। পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া সেই ছাই গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে হয় হিন্দু পুরাণদের মতো। আমরা কমবেশি সব ধর্মেরই কিছু না কিছু বিষয়গুলো আঁকড়ে ধরে রাখি। সাথে আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রাচীন কুসংস্কার তো আছেই, এগুলো থেকে যায়, এগুলো কখনো যাবে না। রক্তের মধ্যে প্রবাহিত হতে থাকে মানুষের প্রাচীন কুসংস্কারগুলো। সে কুসংস্কারের মধ্যে কিছু সংস্কারও থাকে, কিছু থাকে না। এখন আসলে কুসংস্কারও খিচুড়ির মতো, সবকিছুর মিলে-ঝিলে হয়ে গেছে। বর্তমান যুগের যে দর্শন, সে দর্শনের প্রাচীন কোন মূলভাবই নেই, সব বদলে গেছে। প্রযুক্তিকে কখনোই আসলে দোষ দেয়া যায় না। প্রযুক্তি তো কখনো মানুষকে সৃষ্টি করেনি; মানুষ প্রযুক্তিকে সৃষ্টি করেছে, প্রযুক্তিগত মূল্যায়নকেও সৃষ্টি করেছে। মানুষের সৃষ্টিই মূল্যায়ন-অবমূল্যায়ন তৈরি করেছে। তাহলে কি করে আমি একটা প্রযুক্তিকে দোষ দেবো, কোনো অবজেক্টকে দোষ দেবো, কোনো জিনিসকে দোষ দেবো? কোন জিনিসেরই আসলে কোন দোষ নেই; সবই মানবসৃষ্ট। মানবসৃষ্ট কত অনুভূতি-আবেগগুলো যুগে যুগে পরিবর্তন হচ্ছে। ঐ যে বললাম কষ্টগুলো ভনিতা মনে হয়, ভালোবাসাগুলো ভন্ডামী মনে হয়; এখন সরাসরি মানুষ খুব প্রাসঙ্গিক বিষয়ে চলে যায়। খুবই প্রাসঙ্গিক, যেখানে ভালোবাসার বিন্দুমাত্র ফোঁটাও থাকে না। নিজেকে ভালোবাসা আর নিজের ভুলগুলোকে আড়াল করে রাখার মধ্যে পার্থক্য আছে। নিজেকে ভালোবাসা মানে নিজের যত্ন নেওয়া, নিজের চিন্তা-ভাবনা গুলোকে গুছিয়ে ঠিক করে রাখা। নিজের মন-মানসিকতা গুলোকে একটা আঙ্গিকে সাজিয়ে রাখা, নিজের ভাষাগত পরিবর্তন করা, সভ্যতার সাথে সাথে নিজেকে আরও বেশি সভ্য করা, এটাই হচ্ছে নিজেকে ভালোবাসা। আর নিজের ভুলগুলোকে যারা আঁকড়ে ধরে রাখে এবং সেটাকে বাঁচিয়ে রাখে, নিজের ভুলগুলোকে ঢেকে রাখে, তারা নিজেদেরকে ভালোবাসে না; তারা নিজেদেরকে প্রতারণা করে। নিজেদের সাথেই নিজেদের প্রতারণা হয়। আমার নিজের মাঝেই তো নিজে আমি প্রতারক, নিজের মাঝেই নিজে যুদ্ধ করে যাচ্ছি, আমি নিজেই তো পরাজিত হওয়ার ফলাফল তৈরি করছি। আবার আমিই সেই মুখ দিয়ে বলছি যে, মানুষ এতো দুর্বল কেন? সেই মানুষ দুর্বলতার প্রাসঙ্গিকগুলো আমি থেকে আলাদা নয়। যখন একটা মানুষ কাপড় পরে নিজের মান-সম্মানকে ঢেকে রাখে, ভাষাগত দিক থেকেও কিছু কাপড় পরিধান করতে হয়, কিছু ভাষার পরিবর্তনকে ঢাকার জন্য আরেক ধরনের পাশাপাশি যে ভাষাগত সভ্যতা আছে সে সভ্যতার ব্যবহার করতে হয়। অনেক সময় দৃষ্টিভঙ্গিকেও কিছু ভালো কাপড় পরিয়ে দেয়া লাগে সুন্দর করে সাজিয়ে গুজিয়ে দৃষ্টিভঙ্গিগুলো প্রকাশ করার জন্য। আমরা ভুলে যাই, অনেক কিছু ভুলে যাই এবং খুব তাড়াতাড়ি আমরা ভুলে যাই। এর বৈজ্ঞানিক অনেক ব্যাখ্যা আছে কি? সাইকোলজি অনেক ধরনের গবেষণা আছে কি? মানুষ যখনই কোন বিষয়ের মধ্যে খুব বেশি আগ্রহ খুঁজে পায়, যেই প্রাচীন আগ্রহ, যে ঘুমিয়েছিল, সেই ঘুমে থাকা দানব আনন্দিত হয়ে যায়, উত্তোলিত হয়ে যায়। তখন কি হয়? পড়ে থাকা যে জ্ঞানগুলো, সে জ্ঞানগুলোকে যখন আমি খাইয়ে-দাইয়ে বড় করছি, তাকে আমি একপাশে রেখে ফেলে দেই, আর ঘুম পাড়িয়ে রাখা দানবকে আমি মূল্যায়ন করি। এজন্যই আমরা ভুলে যাই মাঝে মাঝে নিজেদের সভ্যতা, নিজেদের আদব, অনেক কিছুই আমরা ভুলে যাই; মনে রাখতে পারি না। এজন্য ঘুমন্ত দানবকে সম্পূর্ণভাবে মেরে ফেলতে হবে অথবা তাকে অন্য জায়গায় প্রস্থান করতে হবে। কোন কিছুই মরে না; প্রস্থান হয়, এক আকার থেকে আরেক আকারে যায়, কোন কিছুই মরে না; পারে না, কোন না কোন আকারে তার আকার বদলে যায়।

কখনো ভালোবাসার আকার বদলে যায়, কখনো বেঁচে থাকার আকার বদলে যায় কিন্তু মরে যায় না। এই মরে যাওয়া শব্দটা মানুষের তৈরি, মানুষের কল্পনা থেকে সৃষ্টি। মৃত্যু, মৃত্যু কি? একটা প্রস্থান, এক পৃথিবী থেকে আরেক পৃথিবীর প্রস্থান। যে দেহটা দেওয়া হয়েছে সে দেহটা, যে পৃথিবীর মাটি থেকে নেওয়া হয়েছে সেই পৃথিবীর মাটিতে ফেরত দিয়েই নিজের যে আত্মা সে আত্মার প্রস্থান; যেখান থেকে এসেছি সেখানেই প্রস্থান, কিভাবে মৃত্যু হলো? মৃত্যুর কোন আকার নেই, কোন কিছুই মরে যায় না। গতকাল যা ছিল তা আমি ফেরত পাবো না, তাহলে গতকালও মরে গেছে? না, গতকাল আজকে একটা নতুন আকার তৈরি করেছে, প্রস্থান করছে। অতীত সবসময় বর্তমানকে প্রস্থান করে আর বর্তমান সবসময় ভবিষ্যতকে।
এটা এমন একটা চক্রাকার বৃত্ত যার মধ্যমণি হচ্ছে আমরা মানুষরা। পশু-পাখিদের মধ্যে এত যাচাই-বাছাই ক্ষমতা নেই, এত চিন্তা-ভাবনা ক্ষমতা তাদের নেই, তারা এত চিন্তা করে না। তাদের জৈবিক চাহিদা ছাড়া আর কোন চাহিদা তাদের প্রয়োজন নেই। তাদের মার্কেটে গিয়ে সোনার গহনা কিনতে হয় না, পার্টির জন্য লং ড্রেস বা শাড়ি কিনতে হয় না, পার্লারে গিয়ে তাদের মেইকআপ করতে হয় না। এত চিন্তা-ভাবনা করার তাদের প্রয়োজন নেই। তাদের সমাজে; পশুদের সমাজে, জানোয়ারদের সমাজে শাড়ি-গহনা পরে, সাজুগুজু করে বিয়ে খাওয়ারও রেওয়াজ নেই। এগুলো সব আমাদের মধ্যে, আমরা দেখাতে ভালোবাসি। কারণ আমরা দেখতে ভালোবাসি। আমরা শুধু দেখাতে না, দেখতেও ভালোবাসি। আমরা দেখাই, কারণ আমাদের ভেতরে বিশ্বাস তৈরি করতে হবে আমি সুন্দর। আমরা দেখাই, কারণ আমাদের ভেতরে একধরনের আস্থা, একটা উৎসাহ তৈরি করতে হবে যে, আমি পৃথিবীতে এসেছি আমার যে প্রতিভা গুলো আছে সেগুলো মুক্ত করার জন্য। পৃথিবীতে যদি কোন মানুষ না থাকতো, তাহলে দেখাতাম কি করে? আমরা দেখাতে পারতাম না। আমাদের চিন্তা-ভাবনাগুলো সম্পূর্ণ আলাদা। আমরা অন্য কোন পশু-পাখি-প্রাণী এবং অন্যান্য জীবন থেকে আলাদা। আমাদের মধ্যে ভালো-মন্দ, ভালো-মন্দের মধ্যে কিছু ভালো-মন্দ আছে যেগুলোর কিছু গবেষণা আমরা কখনোই করি না। যখন খালি বসে থাকি তখন মাথার ভিতরে অনেক ধরনের খেলা চলে। কখনো বা ছবি চলে, কখনো ছায়াছবি চলে, কখনো গান চলে, কখনো নিজেরা নিজেদের ছায়াছবি তৈরি করি। সেই ছবির ডিরেক্টরও আমরা হই, লেখকও আমরা হই, নায়ক-নায়িকাও আমরা বানাই। বাস্তবে যখন ফেরত আসি, আমাদের এই মাথার ভেতরে সেই নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গির সিনেমাগুলো চলতে থাকে। কিন্তু বাস্তবে সেই মানুষগুলোর সাথে কোন মিল পাওয়া যায় না। তখন আমরা ভুল বুঝি। এই যে বলে না, কেন ভুল বুঝে? আমরা চিন্তা করি একটা, বাস্তবে ঘটে আরেকটা। কারণ আমরা সিনেমা বানাবো নিজেরা নিজেদের মধ্যে। এই সিনেমাগুলো আমাদের মধ্যে আমরা নিজেরাই চালাই। এজন্য বিশ্বাস করতে পারি না বাস্তবে এর ব্যতিক্রম হবে। এটাই সত্য।

বিদিতা রহমান